বৃহস্পতিবার, ০৭ অগাস্ট ২০২৫, ০৫:২৩ অপরাহ্ন
আবুল কাসেম ফজলুল হক:: কোনো কোনো সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেল থেকে কয়েকজন সাংবাদিক খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের রাজনৈতিক তাত্পর্য সম্পর্কে আমার মত জানতে চেয়েছেন। তাত্ক্ষণিক কোনো মত ব্যক্ত করতে আমি অপারগতা প্রকাশ করেছি।
ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি এরশাদ দুই মেয়াদে প্রায় সাত বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। ওই ঘটনার রাজনৈতিক তাত্পর্য কী? তাতে দুর্নীতি কি একটুও কমেছে? রাজনীতির মান কি একটু উন্নত হয়েছে? খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড ভোগ দ্বারা দেশে দুর্নীতি কমবে? রাজনীতির মান উন্নত হবে? আমার মনে হয় না, এ দুয়ের একটিও হবে।
খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে বিএনপি দুর্বল হবে এবং আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হবে—এ কথা অনেকে বলছেন। এটাও এখনই বলা যায় না। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ও রিভিউ হয়ে মামলার রায় চূড়ান্ত হতে কত দিন লাগবে কে জানে? জামিনে থেকে খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না তাও এখনই বলা যাচ্ছে না। কিছু লোক বলছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচন করার সুযোগ পেলে পাঁচ আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পাঁচটি থেকেই বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত হবেন। কে জানে কী হবে? আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংহতি এবং দলীয় শৃঙ্খলার অবস্থা কেমন থাকবে, তাও বলা যায় না। খালেদা জিয়া কারাগারে বন্দি থাকলে বিএনপি কি অনৈক্যের মধ্যে পড়ে যাবে? লন্ডনে অবস্থানকারী দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমান বিএনপিকে কতটা পরিচালনা করতে পারবেন, তাও বলা যায় না। তারেক রহমানের কোনো সন্তানের কি বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণের মতো বয়স হয়েছে? অতীতে কখনো কখনো খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে তারেক রহমানের স্ত্রীকে বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্বে আনার কথা পত্রপত্রিকায় আলোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রীদের চিন্তা এখনো বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্রের বাইরে যায় না। এ দেশের জাতীয়তাবাদীদের চিন্তা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় দূতাবাসগুলোর ওপর নির্ভরশীল। কখনো দুই ধারার জাতীয়তাবাদীরাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে চলে যান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের জন্য। এই রকম অনেক ব্যাপার আছে যেগুলোর বিবেচনা বিএনপির কী হবে, আওয়ামী লীগের কী হবে, তা বিবেচনা করার সময়ে বিবেচনায় ধরতে হবে।
খালেদা জিয়া কারাগারে গিয়েছেন, এটা অবশ্যই তাঁর জীবনে অত্যন্ত বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। সারা দেশে বড় বড় দুর্নীতিবাজরা সব দুর্দৈবের মতো দোর্দণ্ড প্রতাপে বহাল তবিয়তে আছেন, শুধু খালেদা জিয়া কারাগারে দণ্ড ভোগ করছেন—এতে তিনি দেশবাসীর মানবীয় সহানুভূতি অবশ্যই পাচ্ছেন। দুর্নীতি তো চলছে! ব্যাংক খাতে কী চলছে? অনেকে বিজয়ীর দম্ভ নিয়ে পরাজিত খালেদা জিয়ার প্রতি অত্যন্ত উদ্ধত ভাষায় কটূক্তি করছেন। এর জন্য কি তাঁদের প্রতি লোকের সমর্থন বাড়ছে? আসলে সব কিছুই নির্ধারিত হচ্ছে শক্তি দ্বারা। রাজনীতি এখানে নগ্ন ক্ষমতার লড়াই। এতে মানবীয় বিষয় অল্পই আছে। দুর্বল হলেই দুর্ভোগে পড়তে হবে। জঙ্গলের নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম। মানুষের বেলায় দুর্বল হওয়া, দুর্বল থাকা অন্যায়। জঙ্গলের নিয়মে মানুষের সমাজ চলতে পারে না। বিএনপির উদ্ধার লাভের উপায় বিএনপিকেই করতে হবে। Honesty is the best policy—ইংরেজদের অভ্যন্তরীণ এই নীতি বিএনপিকে তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে গ্রহণ করতে হবে।
আমার কোনো সন্দেহ নেই যে বিএনপি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় পড়ে গেছে। ২০০৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময়েই দলটি দুর্বল হয়ে যায়। তারপর ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে, শক্তি অর্জন করতে পারেনি। এর মধ্যে ঘটল খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড। যদি বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসত এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত অবস্থানে থাকত, তাহলে ঠিক এর বিপরীত ঘটনা ঘটত। এই রকমই বাংলাদেশের রাজনীতির মান। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কিংবা অন্য কোনো দলকে গড়ে উঠতে দেবে—এমন আশা সম্পূর্ণ অবান্তর। যারা উঠতে চায় তাদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে ওঠার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকেই সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো (CSO) নিয়ামক ভূমিকা পালন করে আসছে। মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী এটা বোঝেন। হয়তো এটাও বোঝেন যে সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে আর্থিক মদদপ্রাপ্ত সুশীল-সুজনদের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক বিকাশের জন্য কল্যাণকর নয়। সেই ১৯৮০-এর দশক থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সুশীল-সুজনদের পরিচালনায় কাজ করে আসছে। হয়তো তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে দিন দশেক আগে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ‘সুশীল’ নামে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশকে নিয়ে কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁর মতে, যারা সরাসরি রাজনীতি না করেও ক্ষমতায় আসতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে টিভি চ্যানেলগুলো প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রচার করেছে। পরের দিন সংবাদপত্রগুলোতে এ খবর গুরুত্ব পায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যাঁদের নিয়ে গাধার গল্প ফেঁদেছেন তাঁরা এ প্রশ্নে সম্পূর্ণ নীরব আছেন এবং আগের ধারায়ই কাজ করে যাচ্ছেন।
তাঁদের কাজ হলো সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান। তাঁদের অনেকের মতে, খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘও খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য করেছে। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলা হলেও খালেদা জিয়াকে রক্ষা করার, উদ্ধার করার, বিএনপিকে জয়ী করার উপায় সম্পর্কে স্পষ্ট করে তাঁরা কিছু বলেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানই একমাত্র বিবেচ্য।
দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জনগণের পক্ষ থেকে শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্রদের থেকে অভিযোগের অন্ত নেই। এখন দেখা যাচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি সামনে আনার ফলে অন্য সব সমস্যার বিবেচনা চাপা পড়ে গেছে। প্রচারমাধ্যম শুধু এ প্রশ্ন নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছে।
গণতন্ত্রের ব্যাপারেও তা-ই হয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আলোচনা দিয়ে গণতন্ত্রের গুরুতর সব বিষয়কে চাপা দেওয়া হয়েছে। গত ৩৫ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে একই আলোচনা, একই কথা।
নির্বাচন সুষ্ঠু হলেই কী, না হলেই কী। প্রশ্ন ফাঁস হলেই কী, না হলেই কী। রাজনীতিতে কি গণতন্ত্র আছে? শিক্ষানীতিতে ও শিক্ষাব্যবস্থায় কি শিক্ষা আছে? জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, সিএসও, এনজিও—এসব প্রশ্নে আলোচনা করতে, মত প্রকাশ করতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক।
আমরা কথিত উদার গণতন্ত্র নিয়ে কোনো উদ্ধত অবস্থা আশা করতে পারি না। গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন চাই। আমরা চাই সর্বজনীন গণতন্ত্র। চলমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরা সুস্থ, স্বাভাবিক জাতীয় শিক্ষা আশা করতে পারি না। আমরা শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার খোল-নলচের পরিবর্তন চাই। এসবের জন্য নতুন চিন্তাধারা ও কর্মধারা আমাদের কাম্য। এনজিও-সিএসওর চিন্তাধারায় গোটা জাতির রাজনৈতিক চিন্তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া দুর্ভাগ্যজনক। এই দুর্ভাগ্য থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য স্ট্যাটাস ক্যুর বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে ও কাজ করতে সাহসী হতে হবে আমাদের।
লেখক : চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়